মিশরের পিরামিড—পাথরের মাঝে খোদাই করা এক গল্প
মিশরের পিরামিড—পাথরের মাঝে খোদাই করা এক গল্প, যা সহস্রাব্দ পেরিয়ে আজও রহস্যের আঁধারে ঢাকা। গিজার মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা এই প্রাচীন বিশালকায় স্থাপত্য বিশ্বজুড়ে গবেষক, বিজ্ঞানী ও কল্পনাবিলাসীদের মুগ্ধ করে রেখেছে। কিন্তু কে বানিয়েছিল এগুলো? কীভাবে? আর তারা কি তারাদের কোনো রহস্য বহন করে? চলুন, সময়ের স্রোতে ফিরে গিয়ে এই গল্পের পরতে পরতে উন্মোচন করি।
কে বানিয়েছিল পিরামিড??
হলিউডের সিনেমার মতো কল্পকাহিনীগুলো ভুলে যান! গিজার পিরামিড, বিশেষ করে গ্রেট পিরামিড, দাসদের দিয়ে নয়, বরং দক্ষ কারিগর ও শ্রমিকদের হাতে তৈরি হয়েছিল। হাজার হাজার মিশরীয় কৃষক, প্রকৌশলী ও স্থপতিরা পরিকল্পিতভাবে দলবদ্ধ হয়ে কাজ করেছিল। তারা আশেপাশের শ্রমিক গ্রামে থাকত, পর্যাপ্ত খাবার পেত এবং এমনকি চিকিৎসাসেবাও পেত! সবচেয়ে বিখ্যাত পিরামিড, "ফারাও খুফুর গ্রেট পিরামিড" (যাকে চিওপস পিরামিডও বলা হয়), তৈরি হয়েছিল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৫৮০ সালে। এর প্রধান স্থপতি ছিলেন হেমিউনু, খুফুর রাজ-উপদেষ্টা। একসময় এই পিরামিড ছিল ১৪৬.৬ মিটার (৪৮১ ফুট) উঁচু, যা প্রায় ৪,০০০ বছর ধরে বিশ্বের সর্বোচ্চ মানবনির্মিত কাঠামো হিসেবে টিকে ছিল!
1.র্যাম্প তত্ত্ব(Ramp Theory)
- দীর্ঘ, সোজা অথবা জিগজ্যাগ র্যাম্প তৈরি করে, পাথরের বিশাল ব্লকগুলো (যার প্রতিটির ওজন ২.৫ থেকে ১৫ টন) উপর দিকে টেনে নেওয়া হতো। - কেউ কেউ বলেন, পিরামিডের চারপাশে একটি সর্পিলাকার র্যাম্প তৈরি করা হয়েছিল।
2.ভারসাম্য ও জলীয় ভাসমান তত্ত্ব( Counterweight & Water Buoyancy Theory)
- - পাথর তোলার জন্য ভারসাম্যের কৌশল ও লিভারের ব্যবহার করা হতে পারে। - নীল নদের জল ব্যবহারের মাধ্যমে পাথর ভাসিয়ে তোলা হয়েছে, এমন ধারণাও আছে।
3.অভ্যন্তরীণ সর্পিল র্যাম্প তত্ত্ব (Internal Spiral Ramps)
ফরাসি স্থপতি জ্যাঁ-পিয়ের হুদিন ধারণা করেন, পিরামিডের ভেতরে গোপন সর্পিলাকার র্যাম্প ছিল, যা দিয়ে ধাপে ধাপে পাথর তোলা হতো।
তারাদের সাথে সম্পর্ক – পিরামিড কি মহাবিশ্বের মানচিত্র?
প্রাচীন মিশরীয়রা ছিল দুর্দান্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানী। গিজার পিরামিডগুলো প্রায় নিখুঁতভাবে উত্তরমুখী (True North)অবস্থানে স্থাপন করা হয়েছে, যা তখনকার জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতার প্রমাণ।
একটি জনপ্রিয় তত্ত্ব হচ্ছে , গিজার তিনটি প্রধান পিরামিডের বিন্যাস ওরায়ন (Orion) নক্ষত্রমণ্ডলীর সাথে মিলে যায়, বিশেষ করে ওরায়নের বেল্টের তিনটি তারা—আলনিতাক, আলনিলাম ও মিনতাকা। ওরায়নকে ওসাইরিস দেবতার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়, যিনি মিশরীয় পুরাণ অনুযায়ী মৃত্যুর দেবতা। গ্রেট পিরামিডের কিছু অভ্যন্তরীণ সুড়ঙ্গ নির্দিষ্ট তারার দিকে ইঙ্গিত করে— - একটি সুড়ঙ্গ ওরায়নের বেল্টের দিকে তাক করে আছে। - অন্যটি **সিরিয়াস (Sirius) তারার দিকে, যা আইসিস দেবীর সঙ্গে যুক্ত। - পুরো পিরামিডের বিন্যাস পোলারিস (উত্তর নক্ষত্র)-এর গতিবিধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আরও একটি চমকপ্রদ তথ্য— কিছু তারাকে "পরম নক্ষত্র" (Circumpolar Stars) বলা হয়, যেগুলো কখনো দিগন্তের নিচে নামে না, বরং সারা বছর রাতের আকাশে দৃশ্যমান থাকে। মিশরীয়রা বিশ্বাস করত, এগুলোই মৃত ফারাওদের আত্মার চিরন্তন আবাস।
এটি এক বহুল প্রচলিত ধারণা! অনেকে মনে করেন, মানুষের পক্ষে এত বিশাল ও নিখুঁত কাঠামো তৈরি করা অসম্ভব ছিল। কিছু যুক্তি হলো— - বিশাল পাথরের ব্লক এত নিখুঁতভাবে কাটা হয়েছিল যে, আধুনিক প্রযুক্তি ছাড়া তা করা কঠিন। - জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিতের যে জ্ঞান দরকার, তা কি সত্যিই তখনকার মানুষের ছিল? - মিশরীয় পুরাণে "স্বর্গ থেকে আসা দেবতাদের" গল্প পাওয়া যায়, যারা মানুষকে শিক্ষা দিয়েছিল। তবে মূলধারার প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এ ধারণা নাকচ করে বলেন, প্রচুর প্রমাণ রয়েছে যে এটি সম্পূর্ণ মানব নির্মিত।
- কিছু মিশরীয় হায়ারোগ্লিফে দেখা যায় অদ্ভুত আকৃতির উড়ন্ত বস্তু বা অস্বাভাবিক মাথার গঠনযুক্ত চরিত্র। - পুরাণে ঠোথ (Thoth) নামের এক দেবতার কথা বলা হয়েছে, যিনি জ্ঞান, গণিত ও বিজ্ঞান শেখানোর জন্য পৃথিবীতে এসেছিলেন। - মালির ডোগন (Dogon) সম্প্রদায় বহু শতাব্দী আগে থেকেই সিরিয়াস বি নামে এক তারার অস্তিত্ব জানত, যা শুধুমাত্র আধুনিক টেলিস্কোপে দেখা যায়! এলিয়েনরা কি সত্যিই আমাদের পৃথিবীতে এসেছিল? হয়তো, হয়তো না! কিন্তু পিরামিড আজও এক মহাবিশ্বের নিরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, রাতের আকাশের নক্ষত্রদের দিকে চিরন্তন দৃষ্টিপাত করে, যেন এক অনন্ত রহস্যের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সময়কে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
Famous WOW Signal